Thursday, 23 November 2017

ডিম কাদের জন্য উপকারী, কাদের জন্য ক্ষতিকারক?


সবার কাছে অতি পরিচিত খাদ্য ডিম। এটি পরিপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার, যা শরীরের নানা উপকার ও স্বাস্থ্যের জন্য অতি উত্তম। ডিম নিয়ে আমাদের মাঝে নানা ভুল ধারণাও আছে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ডিম খাওয়া নিয়ে অনুমাননির্ভর দুশ্চিন্তায় ভোগেন। অনেকে মনে করেন, ডিমের কোলেস্টেরল হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) সৃষ্টি করে। আবার কেউ মনে করেন ডিম খেলে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপ্রেসার হয়। পেটে গ্যাস জমা হয়।
কিন্তু আসলে এসব ক্ষেত্রে ডিম কতটুকু দায়ী তা জানা দরকার। আর ডিম কাদের জন্য ক্ষতিকর এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। তা ছাড়া ডিমের উপাদান সম্পর্কে জানা থাকলে আমরা ডিমের মতো সুষম খাবার থেকে বঞ্চিত হবো না।
ডিম মুখরোচক, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, কোলিন ও ভিটামিন সি ছাড়া অন্যান্য ভিটামিনে ভরপুর। ডিমের বাইরের শক্ত খোসা ছাড়া ভেতরের সব অংশই খাদ্য উপযোগী। একটি ডিমের গড় ওজন ৬০ গ্রাম প্রায়। পুুষ্টিমানের দিক দিয়ে হাঁস ও মুরগির ডিমের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দেশী ডিমের চেয়ে ফার্মের ডিমের পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। তবে মুরগির ডিমের চেয়ে হাঁসের ডিমের পুষ্টিগুণ বেশি। কারণ হাঁসের ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে বড়।


বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাত্র ৪৫-৫০টি ডিম খায়। অথচ জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, সুস্থ থাকার জন্য বছরে একজন মানুষের ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। সুষম খাদ্যের অভাবে বাংলাদেশের শিশু থেকে শুরু করে সব ধরনের মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। তাই স্বাস্থ্যরক্ষায় আমাদের খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
ডিমে প্রচুর প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, কোলিন ও আট ধরনের অ্যামাইনো এসিড থাকে, যা সুস্থ দেহ গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ডিমে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড আছে। একটি ডিমে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ১.৮৬ গ্রাম, অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ৩.১২ গ্রাম ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ ২২৫ গ্রাম।
উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের সাথে সম্পৃক্ত চর্বি খাদ্যে মিলিত হয়ে মানবদেহে হৃদরোগ সৃষ্টি করতে পারে, তা সত্য। কিন্তু ডিমে সম্পৃক্ত চর্বির চেয়ে মানবদেহের জন্য উপকারী অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। মানবশরীরের জন্য কোলেস্টেরল খুবই প্রয়োজন। এই কোলেস্টেরলের ভয়ে কেউ কেউ ডিম খান না। অথচ কোলেস্টেরল মানবশরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। পুরুষের সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরন আর মহিলাদের সেক্স হরমোন ইস্ট্রোজেন দেহে তৈরির জন্য কোলেস্টেরল প্রয়োজন। ভিটামিন ডি এবং যকৃতের বাইল এসিডের প্রাথমিক উৎস কোলেস্টেরল।
তা ছাড়া শরীরের বিপাকীয় কাজে কোলেস্টেরল গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। ডিমে প্রচুর ওমেগা-৩ থাকে, যা শরীরের সাইকোটাইনিস নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এ উপাদানটি রক্তে ট্রাইগ্লিসারিনের পরিমাণ কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তা ছাড়া এ উপাদানটি চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে। দেহের সালমোনেলা আক্রমণ রোধ করে, মাংসের ক্ষয় রোধ করে এবং স্তনক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ডিমের এইচডিএল (হাই ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন), অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, ওমেগা-৩ রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায় এবং রক্তনালীতে এলডিএল (লো-ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন) জমতে দেয় না। ফলে হৃদরোগ ও মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ রোগ অনেকাংশে কমে যায়।
ডিমে কোলিন নামে যে উপাদান থাকে তা মস্তিষ্ক গঠন করে ও সুস্থ-সবল রাখে। তাই শিশুদের ডিম খাওয়ালে মস্তিষ্কের সঠিক গঠন ও পরিপক্ব হয়। কোলিন যকৃতের (কলিজা) কাজ স্বাভাবিক রাখে। শিশুদের নিউরন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। গর্ভবতী মহিলাদের প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ালে গর্ভের শিশুর উন্নত স্মৃতিশক্তি তৈরি হয়। ডিমের জৈব ক্রোমিয়াম ইনসুলিন উৎপাদনের মাধ্যমে রক্তের শর্করা বা চিনির সমতা বজায় রাখে।

পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, একটি ডিম থেকে যে খাদ্য উপাদান পাওয়া যায় তা নি¤œরূপ : খাদ্যশক্তি ১৮১ কিলোক্যালরি, আমিষ ১৩.৫ গ্রাম, চর্বি ১৩.৭ গ্রাম, শর্করা ০.৮ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭০ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩ গ্রাম, পানি ৩৫ গ্রাম, কোলেস্টেরল ২২৫ গ্রাম, সোডিয়াম ০.১২ গ্রাম, ক্লোরিন ০.১৮ গ্রাম, পটাশিয়াম .১২ গ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.৫ মিলিগ্রাম, বি-৬ ০.১৪ মিলিগ্রাম, নিয়োসিন ০.৭ মিলিগ্রাম, থায়ামিন ০.০৬ মিলিগ্রাম, ই-৭ ৪০ মিলিগ্রাম, বি-২ ৩১০ মিলিগ্রাম, বি-১২ ১ মিলিগ্রাম, এ- ৭৪০ মিলিগ্রাম, ফলাসিন ৪৬ মিলিগ্রাম কোলিন ১২৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৯৬ মিলিগ্রাম, সেলেনিয়াম ১৫.৮ মাাইক্রোগ্রাম। ডিমের সাদা অংশ বা অ্যালবুমিন ৩৪-৩৫ গ্রাম থাকে, যা ডিমের মোট ওজনের শতকরা ৫৭ ভাগ। এ অ্যালবুমিন মিউকাস মেমব্রেনকে সুরক্ষা করে পাকস্থলীর প্রদাহ, আলসার ও ডায়রিয়া প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ প্রতিদিন ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত কোলেস্টেরল গ্রহণ করতে পারে। ডিমে থাকে ২২৫ গ্রাম কোলেস্টেরল। সুতরাং ভয় করে ডিম খাওয়া বাতিল করা উচিত নয়। যদি আপনার দেহে কোলেস্টেরল আগে থেকে বেড়ে না থাকে, তাহলে ডিম খাওয়া বাদ দেয়া উচিত নয়। তবে মনে রাখবেন, আপনার শরীরের সমস্যা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ডিম খাবেন। কাঁচা ডিমে সালমোনেলা সিগেলা নামক জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। গরমের সময় এ আশঙ্কা আরো বেশি থাকে। তাই কাঁচা ডিম খাওয়া উচিত নয়।
অনেকে মনে করেন, ডিম খেলে বাত হয়। তা সঠিক হয়। বাতের অন্যতম কারণ হলো রক্তের ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। ডিমের সাদা অংশে যে ইউরিক এসিড থাকে তা খুবই সামান্য, যা আমাদের শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। ডিমে ফসফরাস থাকে, যা দেহের হাড় গঠনে সাহায্য করে। কুসুমে থাকে ফোলেট, যা রক্তকোষ তৈরিতে সাহায্য করে এবং কুসুমে জিংক থাকে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সেদ্ধ ডিম খেলে চোখের ছানিপড়া ও অন্ধত্ব দূর হয়।
লেখক : শিক্ষক, ফুলসাইন্দ দ্বিপাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ , গোলাপগঞ্জ, সিলেট
source file : http://bdexpress.uodoo.com

No comments:

Post a Comment