দেশের বেকারত্ব নিরসনে নতুন দিক উন্মোচন করতে যাচ্ছে টার্কি পালন। যেখানে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪৬% সেখানে অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগ করেই এক বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ লাভের মুনাফা দেখতে পারছেন টার্কি খামারিরা। বাংলাদেশে টার্কি পালন নতুন হলেও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপক হারে পালন করা হচ্ছে টার্কি। নতুন জন্ম নেয়া বাচ্চা কম সময়ের মধ্যে লালন পালন করেই মাত্র তিন মাসের মাথায় টার্কিগুলো দ্বিগুণের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করে বেশ ভালো মুনাফা দেখতে পারছেন টার্কি খামারিরা।
অংশীদারির ভিত্তিতে ২০১৬ সালের মে মাসে রাজধানীর দক্ষিণ মাণ্ডা এলাকায় ১৩৩টি টার্কি মুরগি নিয়ে খামার গড়ে তুলেন সেলিম মিয়া। খামারের নাম দেন কাঁশবন অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড। সেলিমের পাশাপাশি আছেন আরও তিনজন অংশীদার। জমি নির্ধারণ, টার্কি বাচ্চা কেনাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে সর্বমোট বিনিয়োগ করছেন প্রায় ৮০ লাখ টাকা। তিলে তিলে গড়ে উঠা এই খামারে এখন টার্কি মুরগির সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সপ্তাহজুড়ে বিক্রি করা হচ্ছে টার্কি।
কথা হয় কাঁশবন অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মো. আকরাম হোসেনের সাথে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা গত বছর ভারত থেকে মাত্র ১৩৩টি টার্কি মুরগি নিয়ে টার্কি খামার গড়ে তুলি। এরপর এই বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫০টি। তবে এখন পর্যন্ত ফার্মের মুরগির মতো একসঙ্গে দুই হাজার বা তার থেকেও বেশি বাচ্চা ফুটানোর মতো অবস্থা হয়নি টার্কির। আমি মনে করি টার্কি এখনো রাজখানার মধ্যে আছে। এটি এমন একটি মুরগি এটি কখনো ব্রয়লার কিংবা লেয়ার মুরগির মতো হবে না। তবে টার্কি যদি নিচের লেয়ারেও আসে তা একটা মানের মধ্যে থাকবে।’
টার্কির দরদাম
দামের ব্যাপারে আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন গত বছর কিনে এনেছিলাম তখন এর আরও অনেক দাম ছিল। তবে এখন খামারের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এর দাম কিছুটা হলেও কমছে। তবে এই মুহূর্তে দাম কিছুটা বেশি। বছরে বেশ কয়েকবার এর দাম উঠানামা করে। এটি মূলত হয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। এখন ১৫ দিন বয়সের একজোড়া্ টার্কির দাম এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু। ৩০ দিনের বাচ্চার দাম তিন হাজার টাকা জোড়া। সাড়ে তিন মাস বয়সী জোড়া প্রতি টার্কি এখন পর্যন্ত নয় হাজার টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। তবে এখন পূর্ণ বয়স্ক এক জোড়া টার্কি বিক্রি হচ্ছে ১৪ হাজার টাকায়। আর যেগুলো এখন ডিম পাড়ছে তাদের একটির দামই এখন ১০ হাজার টাকা।
এই টার্কি তিনি রাজধানীর বিভিন্ন চেইনশপ যেমন স্বপ্ন, অ্যাগোরা ও মিনা বাজারে বিক্রি করে দেন। সেখানে পূর্ণবয়স্ক প্রতি জোড়া টার্কি বিক্রি হয় ১৫ হাজার টাকারও বেশি দামে। সেখানে প্রতি টার্কির ওজন হয় সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে আট কেজি পর্যন্ত। সেখানে প্রতিকেজি টার্কির মাংস পাওয়া যায় মানভেদে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়।’ তবে চাহিদার বাড়ার পাশাপাশি যোগান কম থাকায় চাইলেও বেশি টার্কি সরবরাহ করতে পারছেন না তারা।
টার্কির খাবার
খাদ্যের ব্যাপারে খামারের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরত আশরাফ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেসব টার্কির বয়স ৪০ দিনের উপরে, তাদেরকে আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন শাক সবজি খাওয়ানো শুরু করি। এই খাদ্যের তালিকায় থাকে কলমি, হেলেঞ্চা, সরিষা, পালংকসহ বিভিন্ন ধরনের শাক আমাদের তালিকায় থাকে। এই শাক সবজি খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও আমরা মান রক্ষা করি। একটি নির্দিষ্ট কোয়ালিটি ছাড়া আমরা আমরা টার্কিকে কিছুই খাওয়াই না। ফলে খাদ্যে কোয়ালিটি থাকায় আমাদের খামারের টার্কিগুলোতে রোগ আঘাত আনতে পারে না। টার্কির যাতে রোগ বালাই আঘাত না করতে পারে সেই জন্য আমরা আড়াই মাস বয়সী টার্কিকে চারটি ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি।’
‘আমাদের খামারে ঢুকতে হলে প্রত্যেকের ডেটল স্যাভলন দিয়ে রোগ জীবাণু মুক্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। পরতে হবে খামারের রোগ জীবাণুমুক্ত নিজস্ব জুতা। তবে টার্কির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য মুরগির চাইতে অনেক বেশি। দেখা যায়, বার্ড ফ্লু আঘাত হানলেই মুরগি সব মারা যায়। কিন্তু টার্কির কিছু হয় না। আমাদের দেশে অন্যান্য মহামারি রোগ যেমন রাণিক্ষেত হলে দেশের সব হাস মুরগি মারা যায়। কিন্তু টার্কির প্রতিরোধ ক্ষমতা এত বেশি যে এদের জ্বর-ঠান্ডা ছাড়া আর কোনো রোগ আক্রান্ত করতে পারে না।’
টার্কির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি
অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় টার্কির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। প্রতি ২০ সপ্তাহ বয়স থেকে টার্কি ডিম পাড়া শুরু করে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর ১০০টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার মাত্র ২৮ দিনের মাথায় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া শুরু করে। এই ব্যাপারে ব্যবস্থাপক আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে সাধারণত ২৬ সপ্তাহ বয়স থেকে টার্কিগুলো ডিম দেয়া শুরু করে। প্রয়োজনীয় আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকায় বছরে একেকটি টার্কি ৯০টিরও বেশি ডিম দিয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ টার্কি বিকাল থেকে সন্ধ্যায় ডিম দেয়।’
আকরাম জানান, তার খামারে প্রায় সব জাতের টার্কি রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্ল্যাক, রাঙ্গিন সেট, স্লেট, ব্রোঞ্জ, রয়েল পাম্প ইত্যাদি। এর মধ্যে রয়েল পাম্পের দাম সবচেয়ে বেশি। যা বিক্রি হচ্ছে জোড়াপ্রতি ২০ হাজার টাকা। এগুলো আকারে বেশ বড় হয়ে থাকে।
বাসায় পালনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক জানান, ‘টার্কি এখনো ঘরে পালার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বাসার বাইরে কিংবা ছাদে পালনের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি শেড বানাতে হবে। শেডের ভেতরে নরম ফোম দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে এদের আদি জন্ম থাকায় এরা সহজে গরম সহ্য করতে পারে না। তাই ফোম দিলে গরম কিছুটা কম লাগবে। আর যে কাজটি বেশি গুরত্বের সাহায্যে করতে হবে তা হলো জীবাণুমুক্ত রাখা। এর পাশাপাশি খাদ্যের জন্য রাখতে হবে কলমি, হেলেঞ্চা, সরিষা, পালংকসহ বিভিন্ন ধরনের শাক। আর বাৎসরিকভাবে রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রথম আড়াই মাসে চারটি ভ্যাকসিন দিয়ে রাখতে হবে। ভ্যাকসিন না দিলেও এর রোগ বালাই সহজে আক্রান্ত করতে পারে না। অর্থাৎ এই ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করলেই বাসার বাইরে কিংবা ছাদে সহজেই টার্কি পালন করা যাবে।
বেকারত্ব ঘোচাতে টার্কি পালন
এই ব্যবসায় আসার ব্যাপারে খামারের একাংশের মালিক সেলিম মিয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমার এই খামারের ব্যবসার পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসা রয়েছে। মূলত এই ব্যবসায় আসার পেছনে আমার শখ সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে। আর যখন শুনতে পারলাম টার্কি পালনে অন্যান্য হাস মুরগি পালনের মতো কোনো ঝামেলা নেই তখন এই ব্যবসায় করার প্রতি আমার আগ্রহ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আর এই ব্যবসায় অনেক মুনাফা পাওয়া যায়। পূর্ণবয়সী একটা টার্কি আমাদের খামার থেকে বিক্রি হয় গড়ে আট হাজার টাকায়। যা আমাদের কেনা পড়েছিল মাত্র বারো’শ টাকা জোড়ায়। আর এগুলো খুব বাড়ন্ত স্বভাবের।
তিনি বেকার যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি দুই একটি কথা বলতে চাই। আপনারা অল্প কিছু টাকা বিনিয়োগ করে এই টার্কি ব্যবসা গড়ে তুলুন। কারণ এইগুলোর রোগ, খাদ্য, বাসস্থানের জন্য বেশি অর্থ খাটানোর প্রয়োজন পড়ে না। অল্প কিছু জায়গায় টার্কি খামার দিলে আপনি বছর শেষে কয়েকগুণ বেশি লাভ করতে পারবেন।’
No comments:
Post a Comment